খালেদা জিয়ার রাজনীতি করা নিয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের বক্তব্যকে সন্দেহের চোখে দেখছে বিএনপি। বিশেষ করে এই সময়ে বিষয়টির প্রতি আইনমন্ত্রীর বক্তব্যের উদ্দেশ্য নিয়ে দলটির নেতাদের মনে প্রশ্ন জেগেছে। এর মাধ্যমে সরকার কোনো কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে বলেও মনে করছেন দলের স্থায়ী কমিটির কয়েকজন সদস্য।
গত সোমবার রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সভা বসে। ভার্চুয়াল ওই বৈঠকের শুরুতে অনির্ধারিত বিষয় হিসেবে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার রাজনীতি করা, না করা নিয়ে আইনমন্ত্রীর বক্তব্য আলোচনায় স্থান পায়।
বৈঠক সূত্র জানায়, স্থায়ী কমিটির দুজন সদস্য তাঁদের বক্তব্যে বলেছেন, সরকার কী কারণে বিষয়টি সামনে এনেছে, তা পরিষ্কার নয়। এর আগে একাধিকবার সাংবাদিকরা এ বিষয়ে প্রশ্ন করলেও পরিষ্কার কোনো জবাব দেননি আইনমন্ত্রী। এবার তিনি হাসিমুখে যেভাবে খোলামেলা কথা বলেছেন, তাতে সন্দেহ হওয়াই স্বাভাবিক।
দলীয় সূত্র জানায়, বৈঠকে দুই নেতা বলেছেন, এ বিষয়ে বিএনপির কোনো প্রতিক্রিয়া দেখানো উচিত হবে না। তাঁদের যুক্তি, কী কারণে সরকার বিষয়টি সামনে এনেছে, কিছুদিনের মধ্যে তা অবশ্যই স্পষ্ট হবে। তত দিন পর্যন্ত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করাই ভালো।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, সরকারের এক মন্ত্রীর বক্তব্যে বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। এ নিয়ে বিএনপি কোনো মন্তব্য কিংবা বক্তব্য দেবে না, এটা দলের সিদ্ধান্ত।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা বলেন, বিষয়টি স্পর্শকতার। খালেদা জিয়ার রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার সঙ্গে বিএনপির রাজনীতিতে তারেক রহমানের ক্ষমতা খর্ব হওয়ার বিষয়টি যুক্ত। কারণ তারেক রহমান এখন এক হাতে দল চালাচ্ছেন। সব সিদ্ধান্ত তিনিই নিচ্ছেন। খালেদা জিয়া রাজনীতিতে সক্রিয় হলে এই পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে। তাই এ নিয়ে দলের সবার সঙ্গে খোলামেলা কথাও বলা যাচ্ছে না।
১৯ ফেব্রুয়ারি, রবিবার ঢাকায় নবনিযুক্ত সহকারী জজদের ওরিয়েন্টেশন অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘আমি পরিষ্কারভাবে বলেছি, অসুস্থতার গ্রাউন্ডে দুটি শর্ত দিয়ে তাঁকে (খালেদা জিয়া) মুক্ত করা হয়েছে। তিনি রাজনীতি করতে পারবেন না বা রাজনীতি করা থেকে বন্ধ (বিরত) থাকতে হবে, এ রকম শর্ত সেটার মধ্যে ছিল না। কারণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার মনে করে, কারো এই স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ করাটা ঠিক নয়।’
তাহলে কি খালেদা জিয়া রাজনীতি করতে পারবেন? এমন প্রশ্নে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘এটা তো একটা ডেড ইস্যু। এটা নিয়ে কথার প্রয়োজন নেই। তবু যখন জানতে চেয়েছেন, ব্যাপারটি আমি পরিষ্কার করে দিতে চাই। যে চিঠি লেখা হয়েছিল, সেখানে যা বলা হয়েছিল, তাঁর শারীরিক অবস্থা এমন ছিল, সুচিকিৎসা না হলে তাঁর জীবন বিপন্ন হচ্ছে। আপনারাই বিচার করেন, যিনি অসুস্থ, তিনি কি রাজনীতি করতে পারেন? যদি আপনাদের (সাংবাদিকদের) বিবেচনায় মনে হয় তিনি রাজনীতি করতে পারেন, তাহলে আমার মনে হয়, আপনাদের বিবেচনা সম্পর্কেও প্রশ্ন উঠতে পারে।…যিনি অসুস্থ, তিনি রাজনীতি করতে পারবেন না, আমার মনে হয় এটাই বেস্ট জাজমেন্ট।’
আইনমন্ত্রী আরো বলেন, ‘আমি পরিষ্কারভাবে বলতে চাই, তিনি (খালেদা জিয়া) একজন স্বাধীন মানুষ, তিনি কী করবেন, সেটা আমার বলে দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু তাঁকে ৪০১ ধারায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মহানুভবতার কারণে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। তাঁকে অসুস্থ হিসেবে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। সেখানে আমরা কখনো লিখে রাখিনি যে তিনি রাজনীতি করতে পারবেন না।’
বিএনপি নেতাদের বিশ্লেষণ, অন্তত চারটি কারণে এখন এ বিষয়টি আলোচনায় এনেছে সরকার। এক. খালেদা জিয়াকে রাজনীতিতে বাধা না দিতে বিদেশিদের চাপ থাকতে পারে।
দুই. সরকারের কথায় রাজনীতিতে সক্রিয় হলে খালেদা জিয়া অসুস্থ নন এ প্রেক্ষাপটে তাঁকে আবার কারাগারে পাঠানো হতে পারে। কারণ অসুস্থতার শর্তে তাঁর সাজা স্থগিত করা হয়েছিল।
তিন. বিএনপিকে নির্বাচনে আনার শর্ত হিসেবে খালেদা জিয়াকে রাজনীতি করার সুযোগ দেওয়া হতে পারে। আলোচনার ক্ষেত্র তৈরি করার জন্য এ বক্তব্য দেওয়া হয়েছে।
চার. সরকারবিরোধী আন্দোলনের মধ্যে নতুন বিতর্ক তুলে বিএনপিকে ব্যস্ত রাখা। মার্চে বিএনপি বড় আন্দোলনে যেতে চায়—বিষয়টি মাথায় নিয়ে সরকার এই বিতর্ক সৃষ্টি করেছে।
বিএনপির এসব সন্দেহের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে দলের নেতারা বলেন, এর আগেও বিভিন্ন সময় সাংবাদিকরা এ বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। তখন সরকারের পক্ষ থেকে অনেকেই বলে আসছিলেন, অসুস্থতার জন্য মানবিক কারণে সরকারের নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিত আছে। ফলে খালেদা জিয়া অন্য কোনো কর্মকাণ্ড চালাতে পারবেন না। এত দিন বিএনপি এ নিয়ে নানা কথা বললেও বিষয়টি আইনমন্ত্রী স্পষ্ট করেননি। এখন কেন তিনি বিষয়টি নিয়ে খোলামেলা কথা বললেন?
আইনমন্ত্রীর বক্তব্যের এক দিন পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও একই রকম মন্তব্য করেছেন। গত ২০ ফেব্রুয়ারি বিকেলে ঢাকায় অমর একুশে বইমেলায় বাংলাদেশ ছাত্রলীগের স্টল পরিদর্শন শেষে বিএনপি নেত্রীর রাজনীতিতে ‘ফেরার’ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘তিনি বিএনপির নেতা হিসেবে যদি রাজনীতি করতে চান, সে ক্ষেত্রে যে শর্তে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে, সেটি মেনে করতে হবে।’
এর আগে গত ২৬ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতা ও সংসদ সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেছিলেন, খালেদা জিয়া রাজনীতি করবেন না, এমন মুচলেকা দিয়েছেন। বিএনপি তখন সভা-সমাবেশে জোরগলায় শেখ সেলিমের বক্তব্যের বিরোধিতা করেছে।
তবে বিএনপির এক নীতিনির্ধারক বলেন, খালেদা জিয়ার সঙ্গে দলের নেতারা সচরাচর দেখা করতে পারেন না। তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর নজর এড়িয়ে যেতে হয়। গত ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিএনপির গণসমাবেশের আগে তাঁর বাড়ির সামনে তল্লাশিচৌকি বসানো হয়েছিল। এসব দেখে তো মনে হয়, সরকার খালেদা জিয়াকে রাজনীতিতে সক্রিয় হতে দিতে চায় না।