নিউজ ডেস্কঃ
স্বাভাবিক প্রসবের (নরমাল ডেলিভারি) চেয়ে অস্ত্রপচারে (সিজারিয়ান) বেশি শিশুর জন্ম হচ্ছে। সন্তান জন্মদানে রাজশাহীতে অস্ত্রপচারে প্রসব বেশি। তবে চিকিৎসকরা বলছেন, ‘স্বাভবিক প্রসব বেশি হয় সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে। হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে একজন গর্ভবতী নারীর স্বাভাবিক প্রসবের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়। একথায় স্বাভাবিক প্রসবের ঝুঁকি থাকলে ওই গর্ভবতী নারীর অস্ত্রপচারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে ক্লিনিক ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে অস্ত্রপচারে প্রসবে বেশি শিশুর জন্ম হয়ে থাকে’-চিকিৎসকদের সাথে একমত রাজশাহী সিভিল সার্জনও।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, অস্ত্রপচারে কয়েকটি কারণে সন্তান জন্ম দেন মায়েরা। তার মধ্যে উচ্চবিত্ত ঘরের মেয়েদের প্রথম পছন্দ অস্ত্রপচার। তারা চিকিৎসকদের সরাসরি জানায়, সন্তান জন্ম দেওয়ার যে প্রসব বেদনা তারা সহ্য করতে পারবে না। তাই তারা অস্ত্রপচারে সন্তান জন্ম দিতে চান। মধ্যবিত্তদের মধ্যে অস্ত্রপচারে সন্তান জন্ম দেওয়ার প্রবণতা কম। এই শ্রেণির মানুষ বিভিন্ন ক্লিনিক ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে দালালের প্ররোচনায় পড়ে অস্ত্রপচারের মাধ্যমে সন্তান জন্ম দিতে বাধ্য হন। এছাড়া স্বাভাবিক প্রসবে সন্তান জন্ম দানে ঝুঁকি থাকলে তারাও অস্ত্রপচারে শিশুর জন্ম দেন। নি¤œবিত্ত শ্রেণির নারীরা সাধারণত স্বাভাবিক সন্তান জন্ম দেন। তবে প্রথম সন্তান অস্ত্রপচার ছাড়াও শারীরিক সমস্যা থাকার কারণে অনেক সময় তাদেরও অস্ত্রপচারে সন্তান জন্মদানের পথ বেছে নিতে হয়। তবে এই শ্রেণির মানুষেরাও দালালদের খপ্পরে পড়ে বিভিন্ন ক্লিনিক ও হাসপাতালে গিয়ে অস্ত্রপচারে সন্তান জন্ম দিচ্ছেন।
রাজশাহী জেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ের তথ্যমতে, রাজশাহী জেলায় একবছরে (২০২২) নরমাল (স্বাভাবিক প্রসব) ও সিজারিয়ানে (অস্ত্রপচারে প্রসব) জন্ম নেওয়ার শিশুর সংখ্যা ২২ হাজার ৮৪৯টি। এরমধ্যে স্বাভাবিক প্রসব ৮ হাজার ১৬৮ ও অস্ত্রপচারে প্রসব ১৪ হাজার ৬৮১ জন শিশুর জন্ম হয়েছে। সেই হিসেবে স্বাভাবিক প্রসবের চেয়ে ৬ হাজার ৫১৩ জন বেশি অস্ত্রপচারে শিশুর জন্ম হয়েছে। জানুয়ারি মাসে রাজশাহী জেলায় স্বাভাবিক প্রসবে ৭১৪ জন ও অস্ত্রপাচারে ১ হাজার ২২৬ জন শিশু জন্ম হয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে স্বাভাবিক প্রসবে ৬৬৪ জন। একই সময়ে অস্ত্রপচারে জন্ম হয়েছে ১ হাজার ১৭০ জন শিশুর। মার্চে স্বাভাবিক প্রসবে ৭০৪ জন ও অস্ত্রপচারে ১ হাজার ১৮৭ জন শিশুর জন্ম হয়েছে। এপ্রিলে স্বাভাবিক প্রসবে ৬৫১টি ও অস্ত্রপচারে ১ হাজার ২০০ জন, মে মাসে স্বাভাবিক ৬৭৫ জন ও অস্ত্রপচারে ১ হাজার ১১৭ জন, জুনে স্বাভাবিক প্রসবে ৫৯০ জন ও অস্ত্রপচারে ১ হাজার ১৩৩ জন, জুলাইয়ে স্বাভাবিক প্রসবে ৬৪৯ জন ও অস্ত্রপচারে ১ হাজার ১৫০ জন শিশুর জন্ম হয়েছে। এছাড়া আগস্টে স্বাভাবিক প্রসব ৬৬৫ জন ও অস্ত্রপচারে ১ হাজার ২৭৭ জন, সেপ্টেম্বরে স্বাভাবিক প্রসবে ৭২৮ জন ও অস্ত্রপচারে ১ হাজার ৩৩৬ জন, অক্টোবরে স্বাভাবিক প্রসব ৭০০ জন ও অস্ত্রপচারে ১ হাজার ২৫৮ জন, নভেম্বরে স্বাভাবিক প্রসবে ৭২৫ জন ও অস্ত্রপচারে ১ হাজার ৩০৭ জন শিশুর জন্ম হয়েছে। সর্বশেষ ডিসেম্বর মাসে স্বাভাবিক প্রসবে ৭০৩ জন ও অস্ত্রপচারে ১ হাজার ৩২০ জন শিশুর জন্ম হয়েছে।
পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. রাবেয়া বসরী জানান, এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অস্ত্রপচারের চেয়ে স্বাভাবিক প্রসব অনেক বেশি। গত ফেব্রুয়ারি মাসে ১৮ টা স্বাভাবিক প্রসব ও ২টা অস্ত্রপচার হয়েছে। আমরা স্বাভাবিক প্রসবের সংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টা করি। যে সকল মায়েরা ঝুঁকিপূর্ণ তাদের জন্য অস্ত্রপচারের ব্যবস্থা রয়েছে।
এই চিকিৎসক দাবি করে বলেন, কোন মা ও শিশুর জন্য স্বাভাবিক প্রসবের ঝুঁকিপূর্ণ হলে আমরা অস্ত্রপাচারে নিই। এছাড়া স্বাভাবিক প্রসবের সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়। এনিয়ে আমরা ক্যাম্পেইনও করেছি। সেখানে স্বাভাবিক প্রসবের ব্যাপারে মায়েদের বোঝানো হয়েছে। এমন কথার উত্তরে তিনি বলেন, কোন মায়ের পেটে বাচ্চার অবস্থান ভালো না, মায়ের পেটে পানি কমে গেছে অথবা মায়ের শারীরিক কোন সমস্যা আছে, বা সমস্যা হচ্ছেÑ এমন পরিস্থিতিতে অস্ত্রপচার করা হয়। এছাড়া ওই মায়ের আগের সন্তান অস্ত্রপচারে হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে আমরা অস্ত্রপাচারের দিকে যায়। একটা সুস্থ মানুষকে কখনওই অস্ত্রপাচারে নেওয়া হয় না।
এখন মেয়েরা আধুনিক হয়েছে। আধুনিক যুগের সাথে সবাই তাল মেলাচ্ছে। বর্তমান সময়ে অনেক মায়েরা সন্তান জন্মের প্রসব বেদনা সহ্য করতে চান না। তখন তারা বলে অস্ত্রপচার করে দেন, সেটা আলাদা বিষয়। বর্তমান যুগের মায়েরা বেশি বয়সে বিয়ে করছেন। তারা নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে ৩০ বছর পার করে দিচ্ছেন। ফলে তাদের বয়স হয়ে যাচ্ছে। ওই মা যখন সন্তান নিচ্ছেন, তার স্বাভাবিক সন্তান জন্ম দেওয়ার সুযোগ কম। তারা বাচ্চার সুস্থতার দিকে তাকিয়ে ঝুঁকি নেয় না। তারা বলে আমরা অস্ত্রপচার চাচ্ছি। স্বাভাবিক প্রসব করাবো না। এটা পুরোপুরি রোগীর ইচ্ছা।
রাজশাহী জেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ের উপপরিচালক ড. কুস্তরী আমিনা কুইন বলেন, রাজশাহীতে অস্ত্রপচার বেশি, স্বাভাবিক প্রসব কম। প্রতিটা উপজেলায় একটি করে মডেল ক্লিনিক রয়েছে। আমরা আমাদের কর্মদের নিয়ে স্বাভাবিক প্রসবের চেষ্টা করছি, করে আসছি। যে মায়েদের স্বাভাবিক বাচ্চা প্রসবে ঝুঁকি আছে, তাদেরই শুধু অস্ত্রপচার হয়। আমাদের টার্গেট প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব। বাড়িতে প্রসব শূন্যে নামিয়ে আনা। আমাদের সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে ফ্রি প্রসবের সুবিধা রয়েছে। একই সাথে অস্ত্রপচারে হলেও অনেক খরচ কম। তারপরেও মানুষ কেনো যে প্রাইভেট ক্লিনিকে গিয়ে টাকা খরচ করে, এটা বলা সম্ভব না। এখানে একটা চক্র কাজ করে বলে তিনি ধারণা করেন।
স্বাভাবিক ও অস্ত্রপাচার প্রসব:
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে ফেব্রুয়ারির ২৫ তারিখে রাজশাহী নগরীর বুধপাড়ার রেলওয়ে বস্তিতে স্বাভাবিক সন্তান জন্ম দেন শ্রী সঞ্জয় কুমার দম্পতি। এই দম্পতির এটিই প্রথম সন্তান। সঞ্জয় কুমার বলেন, ‘ওষুধ ছাড়াও বিভিন্ন জিনিসপত্র কিনতে তার দেড় হাজার টাকা খরচ হয়েছে। জন্মের পরে তার সন্তান অসুস্থ হয়ে পড়ে। এনিয়ে তার খরচ বেড়ে যায়।’
রইসুল ইসলাম নামের এক অস্ত্রপচারে রোগির স্বামী জানান, হাসপাতালের চিকিৎসক স্বাভাবিক প্রসবের জন্য অনেক চেষ্টা করেছে। কিন্তু শারীরিক কিছু সমস্যার কারণে তার স্ত্রী অস্ত্রপচারে সন্তান জন্ম দেন। তার সব মিলে দুই হাজার টাকার মতো ওষুধসহ জিনিসপত্র কিনতে হয়েছে। তিনি বলেন, বাইরের ক্লিনিকে ১০ হাজার টাকা বলে ছিল দালাল। পরে অন্যদের সাথে যোগাযোগ করে শুনলাম। তারা অল্প বলে ভর্তি করে নিয়ে বেশি টাকা বিল করে। তাই কোন দিকে না তাকিয়ে বড় মেডিকেলে (রামেক হাসপাতাল) ভর্তি করেছি।
চলতি মাসে বর্ণালী মোড়ের ডলফিন ক্লিনিকে ইমন ইসলাম দম্পতির ক্লিনিক কর্তৃপক্ষের সাথে চুক্তি ছিল, অস্ত্রপচারে খরচ ১৭ হাজার ৫০০ টাকা। ইমন ইসলাম জানান, আগে থেকে ক্লিনিক কর্তৃপক্ষের সাথে চুক্তি করে ছিলাম খরচের বিষয়ে। তারা ১৭ হাজার ৫০০ টাকা চেয়েছিলেন। এই প্যাকেজের ভেতরে সব খরচ ধরে নেয় তারা। তিনি বলেন, তাদের প্রথম সন্তান নরমালে হয়। তবে শারীরিক সমস্যা থাকার কারণে সিজার করতে হয়েছে। তবে ক্লিনিকগুলোতে অস্ত্রপচারে কত টাকা খরচ হয়? এ বিষয়ে কয়েকটি ক্লিনিকের সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা টাকার বিষয়ে কথা বলতে রাজি হয়নি। তারা বলেছেন, রোগী চিকিৎসকে দেখাতে হবে। চিকিৎসকই বলবেন কত টাকা খরচ হবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক নারী জানান, অস্ত্রপাচারে সন্তান জন্ম দিলে সমস্যা কোথায়? অনেক নারীই তো সন্তান জন্ম দিচ্ছে। অস্ত্রপচারে সন্তান জন্ম দিলে কিছুদিন বিশ্রামে থাকতে হয়। নিয়মের মধ্যে থেকে ওষুধ খেতে হয়। এটা নারীদের একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। এসব বিষয়ে কথা না বলাই ভালো।
অন্যদিকে, রাজশাহী সিটি করপোরেশনের আরবান প্রাইমারি হেলথ কেয়ার সার্ভিসেস অ্যান্ড ডেলিভারি সেন্টারে স্বাভাবিক শিশুর জন্ম হলে খরচ হয় ১ হাজার ২০০ টাকা। আর অস্ত্রপচারে বিষয়ে তাদের প্যাকেজ করা হয়েছে। পুরো প্যাকেজে ওটি খরচ, বেড ভাড়া, ওষুধ মিলে ১২ হাজার টাকা নেওয়া হয়।
রামেক হাসপাতালের নার্স সুপারিনন্টেন্ড সুফিয়া খাতুন জানান, চলতি বছরের দুই মাসে (জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি) ২ হাজার ৬৩৩টি শিশু জন্ম নিয়েছে হাসপাতালে। এরমধ্যে স্বাভাবিক প্রসব ১ হাজার ৩২৭ ও অস্ত্রপচারে ১ হাজার ৩০৬ জন শিশু জন্ম নিয়েছে। এরমধ্যে স্বাভাবিক প্রসবে জানুয়ারি মাসে ৭১৩ ও অস্ত্রপচারে ৬১৪ জন শিশু জন্ম নিয়েছে। ফেব্রুয়ারি মাসে স্বাভাবিক প্রসবে ৬১৪ ও অস্ত্রপচারে ৬৩৯ জন শিশু জন্ম নিয়েছে। হাসপাতালের ২২ নম্বর ওয়ার্ডে জানুয়ারিতে স্বাভাবিক প্রসবে ২৪২ ও অস্ত্রপচারে ২৪১ জন শিশু জন্ম নিয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে স্বাভাবিক প্রসবে ১৮৯ ও অস্ত্রপচারে ২২৮ জন শিশু জন্ম নিয়েছে। একইভাবে হাসপাতালের ২৩ নম্বর ওয়ার্ডে জানুয়ারিতে স্বাভাবিক প্রসবে ২৫৪ ও অস্ত্রপচারে ১৯৮ জন এবং ফেব্রুয়ারিতে স্বাভাবিক প্রসবে ২৩১ জন ও অস্ত্রপচারে ২২৩ শিশু জন্ম নিয়েছে। হাসপাতালের ২৮ নম্বর ওয়ার্ডে জানুয়ারিতে স্বাভাবিক প্রসবে ২০৬ ও অস্ত্রপচারে ১৮৯ জন এবং ফেব্রুয়ারিতে স্বাভাবিক প্রসবে ১৮৮ ও অস্ত্রপচারে ১৮৮ জন শিশু জন্ম গ্রহণ করে।
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, যে সকল প্রসবে ঝুঁকি থাকে। সেগুলো আমাদের হাসপাতালে আসে। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করি স্বাভাবিক প্রসবের জন্য।
রাজশাহী সিভিল সার্জন ডা. আবু সাইদ মোহাম্মদ ফারুক বলেন, সারা দেশেই স্বাভাবিক প্রসবের চেয়ে অস্ত্রপচার ডেলিভারি বেশি। তবে রাজশাহীতে জানুয়ারির তুলনায় ফেব্রুয়ারি মাসে স্বাভাবিক প্রসবের সংখ্যা বেড়েছে। আমরাও চেষ্টা করছি স্বাভাবিক প্রসব বাড়ানোর। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে স্বাভাবিক প্রসবের সংখ্যা বেশি। কিন্তু এখানে খুব গুরুতর রোগীরা আসেন প্রসবের জন্য। এই রোগীরে স্বাভাবিক প্রসবের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু ঝুঁকি থাকার কারণে অস্ত্রপচারের দিকে যাওয়া হয়। ক্লিনিকগুলো বিষয়ে তিনি বলেন, ক্লিনিকগুলোতে অস্ত্রপচারের সংখ্যা বেশি। ক্লিনিকে হয় কি, রোগীরা (গর্ভবতি) যে চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে শুরু থেকে চেকআপ করেন। তারা তাদের (চিকিৎসক) কাছেই সন্তান জন্ম দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এখন অনেক ক্লিনিকে স্বাভাবিক প্রসব হচ্ছে। স্বাভাবিক প্রসব বাড়াতে আমরাও তাদের নিয়ে কাজ করছি।
সূত্রঃ দৈনিক সোনার দেশ