জহির মসজিদ, মালয়েশিয়া। ছবি : সংগৃহীত
আতাউর রহমান খসরু:
বিদায় নিয়েছে মহিমান্বিত রমজান। রমজান মুমিনের জন্য প্রশিক্ষণকালের মতো। এ মাসে মুমিনরা নেক কাজের অনুশীলন করে, নেক কাজের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। রমজানের পর মুমিনের করণীয় হলো এই আমলের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা। কেননা আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘নবী (সা.) বলেছেন, মহান আল্লাহ ওই আমলকে ভালোবাসেন, যা নিয়মিত করা হয়, যদিও তা পরিমাণে কম হয়। তিনি (সা.) কোনো আমল করলে তা নিয়মিতভাবে করতেন।’ (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ১৩৬৮)
ইবাদতের সময়কাল মৃত্যু পর্যন্ত : কোনো সন্দেহ নেই রমজান ইবাদত, বন্দেগি ও পুণ্যার্জনের মাহেন্দ্রক্ষণ। তবে ইবাদত করার একমাত্র সময় নয়। মুমিন জীবনের কোনো সময়ই আল্লাহর ইবাদত থেকে বিমুখ হবে না। কেননা তার প্রতি আল্লাহর নির্দেশনা হলো, ‘তুমি তোমার প্রতিপালকের ইবাদত কোরো মৃত্যু আসার আগ পর্যন্ত।’ (সুরা : হিজর, আয়াত : ৯৯)
দৃঢ়তার পর শিথিলতা নিন্দনীয় : দ্বিনের ব্যাপারে দৃঢ়তা অর্জনের পর তাতে শিথিলতা প্রদর্শন করা কাম্য নয়। এটা নিজের শ্রম ও প্রচেষ্টাকে নিষ্ফল করে দেওয়ার শামিল। আল্লাহ মুমিনদের এমন কাজ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা সেই নারীর মতো হইয়ো না, যে তাঁর সুতা মজবুত করে পাকানোর পর তার পাক খুলে নষ্ট করে দেয়।’ (সুরা : নাহল, আয়াত : ৯২)
তাফসিরবিদরা বলেন, এ আয়াতে মহান আল্লাহ দ্বিনের ব্যাপারে অধঃপতনের নিন্দা করেছেন। বিশর হাফি (রহ.) বলেন, ‘সেসব ব্যক্তি কতই না নিকৃষ্ট, যারা শুধু রমজানেই তাদের প্রভুকে চেনে।’ (মাফাতিহুল আফকার : ২/২৮৩)
দ্বিনের ওপর দৃঢ় থাকতে সহায়ক আমল
রমজানে মুমিনের জীবনে যে পরিচ্ছন্নতা আসে তা ধরে রাখতে মনীষীরা কিছু আমল করার পরামর্শ দেন। তা হলো—
১. দোয়া করা : মুমিন রমজানের পরও একটি সুন্দর জীবনযাপনের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করবে। আল্লাহর অনুগ্রহেই শুধু মুমিন বিভ্রান্তির হাত থেকে আত্মরক্ষা করতে পারে। পবিত্র কোরআনে মুমিনদের দোয়া শেখানো হয়েছে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক, সরল পথ প্রদর্শনের পর তুমি আমাদের অন্তরকে সত্য লঙ্ঘনপ্রবণ করিয়ো না এবং তোমার কাছ থেকে আমাদের করুণা দান করো। নিশ্চয়ই তুমি মহাদাতা।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ৮)
২. আল্লাহভীতির জীবন যাপন করা : দীর্ঘ এক মাস রোজা আদায়ের প্রধান উদ্দেশ্য তাকওয়া বা আল্লাহভীতি অর্জন করা। আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনরা, তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল পূর্ববর্তীদের ওপর; যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৮৩)
সুতরাং রমজান-পরবর্তী জীবনে যদি আল্লাহর ভয় অন্তরে রেখে চলা যায়, তবে দীর্ঘ এক মাসের সিয়াম সাধনা সার্থক বলে গণ্য হবে। আর আল্লাহভীতিই মুমিন জীবনে সাফল্যের মাপকাঠি। কেননা আল্লাহ বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সেই বেশি সম্মানিত যে বেশি আল্লাহভীরু।’ (সুরা : হুজরাত, আয়াত : ১৩)
৩. মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায় : সমাজের অনেকে রমজান মাসে মসজিদে গিয়ে জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায় করেন এবং রমজানের পর মসজিদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে না—এটি নিন্দনীয়। রাসুলুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যদি ঘরে নারী ও পরিবারের অন্য সদস্যরা না থাকত, তবে আমি এশার নামাজে দাঁড়াতাম এবং দুই যুবককে নির্দেশ দিতাম যারা (জামাতে অংশ না নিয়ে) ঘরে আছে তাদের পুড়িয়ে দিতে।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ৮৭৯৬)
৪. কোরআনচর্চা অব্যাহত রাখা : রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে পরবর্তী যুগের সব মনীষী রমজান মাসে কোরআনচর্চা বাড়িয়ে দিলেও বছরের কোনো সময় তারা কোরআনচর্চা থেকে একেইবারেই বিরত থাকতেন না। রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজে কোরআন পরিত্যাগকারীদের বিরুদ্ধে আল্লাহর দরবারে অভিযোগ করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘রাসুল বললেন, হে আমার প্রতিপালক, আমার সম্প্রদায় এই কোরআনকে পরিত্যাজ্য মনে করে।’ (সুরা : ফোরকান, আয়াত : ৩০)
যদিও উল্লিখিত আয়াতটি মক্কার মুশরিকদের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়েছে, তবে এই আয়াতে কোরআন তিলাওয়াত ও তাঁর চর্চা ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারে সাধারণ হুঁশিয়ারিও রয়েছে।
৫. নফল রোজা রাখা : রমজানের পর রাসুলুল্লাহ (সা.) শাওয়াল মাসে গুরুত্বের সঙ্গে ছয় রোজা পালন করতেন। একাধিক বিশুদ্ধ হাদিস দ্বারা শাওয়ালের ছয় রোজার মর্যাদা ও ফজিলত প্রমাণিত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রমজানের রোজা রাখল, অতঃপর তার সঙ্গে সঙ্গে শাওয়াল মাসের ছয়টি রোজা রাখল, সে যেন পূর্ণ বছরই রোজা রাখল।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১১৬৪)
এ ছাড়া মহানবী (সা.) আইয়ামে বিজ তথা চন্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ রোজা রাখতেন। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, আমার বন্ধু (সা.) আমাকে তিনটি বিষয়ে নির্দেশ দিয়েছেন, প্রতি মাসে তিন দিন করে সওম পালন করা, দুই রাকাত সালাতুদ-দুহা আদায় এবং ঘুমানোর আগে বিতর নামাজ পড়া।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৯৮১)।
৬. তাহাজ্জুদ আদায় করা : রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘রমজানের রোজার পর সবচেয়ে উত্তম রোজা মুহাররমের। আর ফরজ নামাজের পর সবচেয়ে উত্তম হলো রাতের নামাজ।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১১৬৩)
এ ছাড়া নবীজি (সা.) ও সাহাবায়ে কেরাম (রা.) তাহাজ্জুদের নামাজে অভ্যস্ত ছিলেন। কোরআনে তাদের প্রশংসায় ইরশাদ হয়েছে, ‘তারা রাতের খুব সামান্য অংশই ঘুমাত এবং শেষ রাতে তারা আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করত।’ (সুরা : জারিয়াত, আয়াত ১৭-১৮)
৭. ভালো গুণ ধরে রাখা : রমজান মুমিনকে ধৈর্য, সহনশীলতা ও ক্ষমা দান শিক্ষা দেয় এবং মিথ্যা ও পাপাচার পরিহারের শিক্ষা দেয়। কেননা রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা ও সে অনুযায়ী আমল বর্জন করেনি, তার এ পানাহার পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৯০৩)
তাই রমজানের পর মুমিন ভালো গুণাবলি অর্জন ও মন্দ স্বভাব পরিত্যাগের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনরা, তোমরা ঈমান আনো…।’ (সুরা নিসা, আয়াত : ১৩৬)।
উল্লিখিত আয়াতের ব্যাখ্যা আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.) লিখেছেন, আল্লাহ এখানে অর্জিত বিষয় অর্জনের নির্দেশ দেননি; বরং পূর্ণতা, দৃঢ়তা ও ধারাবাহিকতা অর্জনের নির্দেশ দিয়েছেন। মুমিন ঈমানের বৈশিষ্ট্যে দৃঢ়তা অর্জন করবে এবং সর্বদা তার ওপর অটুট থাকবে। (তাফসিরে ইবনে কাসির)
আল্লাহ সবাইকে ভালো কাজের ধারা অব্যাহত রাখার তাওফিক দিন। আমিন