বুঝতে শেখার পর থেকে দেখেছেন মায়ের ওপর বাবার নির্মম নির্যাতন। তাঁকেও একবার পুকুরে ছুড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। বড় হয়েছেন মামাবাড়িতে। অনেক ঝড় মোকাবেলা করে শেষ পর্যন্ত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছেন শতাব্দী রায়। পটুয়াখালীর গলাচিপার এই তরুণীর সংগ্রামের গল্প শুনেছেন পিন্টু রঞ্জন অর্ক
ভবিষ্যতে অসহায় তরুণীদের পাশে দাঁড়াতে চান শতাব্দী রায়।
নিউজ ডেস্কঃ
‘বিধিরে তুই আমায় ছাড়া রঙ্গ করার মানুষ দেখলি না’—ফরিদা পারভীনের কণ্ঠে গানটা যখন শুনি, মনে হয় আমাকে নিয়ে লেখা হয়েছে এটা! মেয়ে হয়ে জন্মানোই যেন অভিশাপ!
আমার জন্ম মামাবাড়িতে, গলাচিপার প্রত্যন্ত হোগলবুনিয়া গ্রামে। দিদির কাছেই বেড়ে উঠেছি। সেখানকার প্রাইমারি স্কুলে বছর দেড়েকের মতো পড়েছি। পরে একদিন বাবা এলেন।
বললেন, ‘আমার মেয়ে আমি নিয়ে যাব। এখানে রাখব না।’ এ নিয়ে অনেক ঝগড়াঝাঁটি হলো। শেষমেশ বাবা আমাকে নিয়ে চরখালীতে দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভর্তি করালেন।
কাজ করে খা
‘বিধিরে তুই আমায় ছাড়া রঙ্গ করার মানুষ দেখলি না’—ফরিদা পারভীনের কণ্ঠে গানটা যখন শুনি, মনে হয় আমাকে নিয়ে লেখা হয়েছে এটা! মেয়ে হয়ে জন্মানোই যেন অভিশাপ! বাবার না ছিল কোনো পৈতৃক সম্পত্তি, না তিনি ঠিকঠাক পরিশ্রম করতেন। ফলে সংসারে অভাব লেগেই থাকত। সপ্তাহে দুই দিন কাজ করলে পাঁচ দিন তিনি টো টো করে ঘুরে বেড়াতেন। স্ত্রী-সন্তানরা যে না খেয়ে আছে, এ নিয়ে কোনো মাথাব্যথা ছিল না।
কিছু বললে উল্টো কথায় কথায় মায়ের গায়ে হাত তুলতেন। বলতেন, ‘তোকে বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াতে পারব না।’
মনে আছে, একবার দুর্গাপূজায় দেবীর ছবি কেনার জন্য বায়না ধরেছিলাম, কিন্তু টাকা নেই বলে কিনে দেননি মা। পূজামণ্ডপ থেকে বাড়ি পর্যন্ত কাঁদতে কাঁদতে এসেছিলাম। মা কিংবা আমি—অসুখবিসুখে পড়লে বাবা ওষুধপত্র দিতেন না।দিদি-দাদু দেখতেন। একবার দুপুরে বাবা বাড়ি এসেছেন। ঘরে চাল নেই। তাই চুলায় হাঁড়ি ওঠেনি। এ নিয়ে কথা-কাটাকাটির এক পর্যায়ে বাবা পিটিয়ে মায়ের মাথা ফাটিয়ে দিলেন। হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল ১৫ দিন। চিকিৎসার খরচ দূরের কথা, তিনি এক দিন দেখতে পর্যন্ত যাননি।
মায়ের দুচোখ ভরা জল
কিন্তু যতই নির্যাতন করুন, সুস্থ হয়ে মা আবার গরিব প্রজার মতো দাঁড়াতেন বাবার সামনে। তখন সম্ভবত চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ি। একদিন স্কুল থেকে ফিরে দেখি, বাবা চুলের মুঠি ধরে মাকে মারছেন। মারার সময় তাঁর কোনো হুঁশ থাকত না। ঘরের বেড়ায় টাঙানো একটা কাস্তে ছিল। এক পর্যায়ে সেটা দিয়ে আঘাত করলেন। সঙ্গে সঙ্গে মায়ের মুখ থেকে রক্ত ঝরা শুরু হলো। দেখলাম সামনের সারির চারটা দাঁত ভেঙে গেছে! অতটুকুন আমি ভয়ে কুঁকড়ে গেলাম। মাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার শুরু করলাম। মায়ের কাছ থেকে আমাকে ছিনিয়ে নিয়ে পুকুরে ফেলে দিলেন! তখন পুরোপুরি সাঁতার জানতাম না। মা ঝাঁপিয়ে পড়ে উদ্ধার করলেন।
তাঁর ছায়া দেখলে ভয় পেতাম
বাবা ছিলেন প্রকাণ্ড চিলের মতো। তাঁর ছায়া দেখলেই মুরগির ছানার মতো মায়ের আঁচলের নিচে লুকানোর চেষ্টা করতাম। মামাবাড়ি চলে যেতে চাইতাম, কিন্তু বাবা কিছুতেই আমাকে যেতে দেবেন না। তারপর হঠাৎ একদিন কী হলো—বাড়ি এসে বললেন, ‘তুই মামাবাড়ি চলে যা।’ পরে বুঝলাম, মামাবাড়ি থাকলে তো মেয়েকে দেখাশোনা করা লাগবে না, বিয়েও দেওয়া লাগবে না। মানে মাথার ওপরে বোঝা নেমে গেল। তাই কারো বুদ্ধিতে রাজি হয়েছেন।
স্যাররা পাশে ছিলেন
মামাবাড়িতে এসে আবার চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি হলাম। বাড়ি থেকে দুই কিলোমিটার দূরে স্কুল। হেঁটেই যেতাম। পাশেই আটখালী মাধ্যমিক বিদ্যালয়। সেখান থেকে জিপিএ ৪.৮৯ পেয়ে এসএসসি পাস করি। পড়াশোনার খরচ তো দূরের কথা, বাবা কোনো দিন কোনো খোঁজ রাখেননি। হাই স্কুলে পড়াশোনার খরচটাও বেড়ে গেল। দিদি-দাদুও বৃদ্ধ। কাজ করতে পারেন না আগের মতো। এ অবস্থায় স্কুলের প্রধান শিক্ষক সুমিত কুমার দত্ত মলয় সহযোগিতা করেছেন। গোবিন্দ স্যার, নুরুল ইসলাম স্যার, সজল স্যার বিনা পয়সায় প্রাইভেট পড়িয়েছেন।
পুরলো না মোর এই জীবনের একটুখানি সাধ
তখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি। অর্ধবার্ষিক পরীক্ষার পর আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন মা। আমার একান্ত আপনজন বলতে আর কেউ রইল না। এত দিন সুখ-দুঃখ সব তাঁর সঙ্গে ভাগাভাগি করতাম। ভেবেছি, নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারলে মায়ের কষ্ট দূর করব! মা চলে যাওয়ার পর জীবনটা আরো জটিল হতে শুরু করল।
মা সব সময় চাইতেন, আমি যেন পড়াশোনা করে ভালো চাকরি করি। তাই এত দুর্যোগের মধ্যেও পড়াশোনায় ছেদ পড়তে দিইনি। নবম শ্রেণিতে রসায়ন, পদার্থবিজ্ঞানের মতো বিষয়গুলো প্রাইভেট পড়ার দরকার হতো, কিন্তু সামর্থ্য ছিল না। বাড়িতে ছোট বাচ্চাদের পড়াতাম। উপবৃত্তি আর টিউশনির টাকা জমিয়ে পড়াশোনার খরচ জোগাতাম। কালেভদ্রে জামাকাপড় কিনতাম। এভাবেই এসএসসি পাস করলাম।
তোকে কে দেখবে?
দিদি-দাদু আমাকে নিয়ে সব সময় চিন্তা করতেন। এ কারণে এসএসসির আগেই বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। প্রায়ই বলতেন, আমাদের কিছু একটা হয়ে গেলে তোকে কে দেখবে? তাঁদের বলতাম, ম্যাট্রিক পাসের পর বিয়ে করব।
অন্যদিকে বাবাও আমাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য তোড়জোড় করতেন। মামাবাড়ি থেকে আমাকে নেওয়ার জন্য ছোট ভাইকে দুইবার পাঠিয়েছেন। এলাকার একটা বেকার, নেশাগ্রস্ত ছেলের সঙ্গে বিয়ের কথাবার্তা প্রায় পাকাপোক্ত করে ফেলেছিলেন। তবে বাবার কথায় কান দিতাম না। এসএসসির পর দাদু বলতেন, ‘এবার বিয়েটা করে নে।’ রাজি হইনি। কারণ মনের মধ্যে শুধু একটাই ধ্যান-জ্ঞান ছিল—আমাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। বুঝতে শেখার পর থেকে বিষয়টা মাথায় গেঁথে গিয়েছিল। কথায় কথায় মায়ের ওপর বাবার অত্যাচার দেখেই বুঝেছি—মেয়েরা স্বাধীন নয়, তাদের পরিবার বোঝা মনে করে। কিন্তু দাদুকে কী বলে বুঝ দেব? পরে বললাম, ইন্টারমিডিয়েটের পর বিয়ে করব। এভাবে নানা কৌশলে তাঁদের শান্ত রাখতাম। সন্ধ্যা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত পড়তাম। পরে আবার রাত ৪টায় উঠে পড়তে বসতাম। এভাবে গলাচিপা সরকারি কলেজ থেকে জিপিএ ৫ পেয়ে এইচএসসি পাস করলাম।
নার্সিংয়ে ভর্তি হলাম
কলেজে হাসান স্যার আমাকে সন্তানের মতো স্নেহ করতেন। তিনিই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে উৎসাহ জোগালেন। কিন্তু ভর্তি প্রস্তুতির জন্য কোচিং করার টাকা কই পাব? হাসান স্যার, মলয় স্যার আর আমার সহপাঠী অপূর্ব বসুর সহায়তায় কিছু টাকা ম্যানেজ হলো, যা খুবই অপ্রতুল। মলয় স্যার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আলমগীর হাসান ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তিনি বরিশালে বিনা পয়সায় কোচিংয়ের ব্যবস্থা করে দিলেন। প্রথমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ হয়নি। হয়েছে পটুয়াখালী সরকারি নার্সিং কলেজে। সেখানেই ভর্তি হলাম।
ভাগ্য সহায় ছিল না
হোস্টেলে ছোট্ট একটা রুমের মধ্যে ১০ জন থাকতাম। ঠিকঠাক পড়াশোনা করা যেত না। হোস্টেলে থেকে টিউশনিও মিলত না। কিন্তু টিউশনি না করলে চলব কী করে? তাই শহরে মেসে থাকতে চেয়েছি। হোস্টেল ছাড়তে চেয়েছি দেখে কলেজের এক ম্যাডাম শোক দিবসের অনুষ্ঠানে সবার সামনে আমাকে অপমান করলেন! আমার আত্মসম্মানবোধে খুব আঘাত লাগল। সিদ্ধান্ত নিলাম নার্সিংই আর পড়ব না। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, নার্সিংয়ের চেয়েও ভালো অবস্থানে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করব। কিন্তু বাড়িতে আসার পর সব কিছু কেমন যেন এলেমেলো লাগল। পটুয়াখালী যাওয়ার আগে যারা হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানিয়েছিল, দেখলাম বাড়ি আসার পরে সেই হাসি মলিন হয়ে গেছে। আশপাশের মানুষের কথা শুনতে শুনতে হতাশার সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছিলাম। আত্মহত্যার কথাও ভেবেছিলাম।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে চাই
পাড়া-প্রতিবেশী সবাই বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছিল। কী করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। তখন একদিন একটা গ্রুপে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী মেহজাবিনের সঙ্গে কথা হলো। সব শুনে তিনি বললেন, আজ যারা তিরস্কার করছে, সফল হলে একদিন তারাই তোমার প্রশংসা করবে। লোকের কথায় কান না দিয়ে তোমার লক্ষ্যে এগিয়ে যাও। আপুর সঙ্গে আলাপের পর সুড়ঙ্গের শেষে আলোর দেখা পেলাম। তিনি আমাকে এনএসজে নামে অনলাইনভিত্তিক কোচিং সেন্টারের একটা মেন্টর নোমান সিদ্দিক ভাইয়ার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। সব শুনে তিনি বললেন, ‘টেনশন কোরো না। আমি তোমার ফ্যামিলিকে বুঝিয়ে বলব।’ তিনি ঢাকা থেকে বই কিনেও পাঠিয়েছিলেন।
পরে লোকের কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে পড়াশোনায় মন দিলাম। ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা দিলাম। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সি’ ইউনিটে ১৬তম হয়েছি। আর সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষায় (গুচ্ছ) ‘বি’ ইউনিটে ৮৭০তম হয়েছি। এখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হব। ভবিষ্যতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে চাই।
অনেক বেদনা সয়ে সয়ে এত দূর এসেছি। এক টাকার মূল্যও আমি বুঝি। ভবিষ্যতে আমার মতো যারা আছে, সেসব তরুণীর পাশে দাঁড়াব।