হজ প্যাকেজ সহনীয় পর্যায়ে আনতে সরকারের চিন্তা করা উচিৎ : হাইকোর্ট

দেশের বেশিরভাগ মানুষ মধ্যবিত্ত। তাদের অনেকের ইচ্ছা থাকলেও হজ করার মত সামর্থ্য থাকে না। ঘোষিত হজ প্যাকেজ বেশিরভাগ মধ্যবিত্তের সামর্থ্যের বাইরে।

আজ বুধবার এ সংক্রান্ত রিট শুনানিতে রাস্ট্রপক্ষকে উদ্দেশ্য করে এসব কথা বলেন বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের ও বিচারপতি মোহাম্মদ আলীর দ্বৈত বেঞ্চ। শুনানির পর ঘোষিত হজ প্যাকেজ সহনীয় পর্যায়ে আনতে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলতে রাষ্ট্রপক্ষকে মৌখিকভাবে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।

আদালত বলেছেন, মধ্যবিত্তের ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা, সামর্থ্যের কথা বিবেচনা করে যতটুকু সম্ভব হজ প্যাকেজ সহনীয় পর্যায়ে আনার বিষয়টি সরকারের চিন্তা করা উচিত।

আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী গাজী মো. মহসীন, রিটকারী আইনজীবী আশরাফ-উজ-জামান। তাদের সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী আজিমুদ্দিন পাটোয়ারী, ইয়াসিন আলফাজ, মো. সাইদুর রহমান ও শফিকুল ইসলাম। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ বি এম আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বাশার। 

পরে আইনজীবী আজিমুদ্দিন পাটোয়ারী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রিটের শুনানি এক সপ্তাহ মুলতবি রেখে আদালত অ্যাটর্নি জেনারেলকে বলেছেন, সরকারের পক্ষে যতটুকু সম্ভব ঘোষিত হজ প্যাকেজের খরচ বা মূল্য কমাতে। এর জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে অ্যাটর্নি জেনারেলকে কথা বলতে বলেছেন।’ এ বিষয়ে জানতে ফোন করেও রাষ্ট্রপক্ষের বক্তব্য জানা যায়নি। 

অযৌক্তিক, অতিরিক্ত খরচ কমিয়ে সরকার ঘোষিত হজ প্যাকেজ পুননির্ধারণ করতে গত ৬ মার্চ বাংলাদেশ, সৌদি আরব সরকারসহ বিভিন্ন দেশের প্রেসিডেন্ট ও সরকার প্রধানকে আইনি নোটিস পাঠান সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আশরাফ-উজ-জামান। কিন্তু এ বিষয়ে দৃশ্যমান পদক্ষেপ দেখতে না পেয়ে গত ১২ মার্চ তিনি হাইকোর্টে রিট করেন। 

রিটে ঘোষিত হজ প্যাকেজের বৈধতা এবং হজ যাত্রায় আন্তর্জাতিক সব এয়ারলাইনস না রাখার সিদ্ধান্তের বৈধতা প্রশ্নে রুল চাওয়ার পাশাপাশি ঘোষিত হজ প্যাকেজের মূল্য পুননির্ধারণের নির্দেশনা চাওয়া হয়। 

রিটে বিবাদী করা হয়- ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সচিব, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক, হজ এজেন্সি এসোসিয়েশনের বাংলাদেশ – হাব ও বাংলাদেশে নিযুক্ত সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূতকে।

গত মঙ্গলবার সে রিটেই আংশিক শুনানি হয়। শুনানিতে হজ প্যাকেজের মূল্য কিসের ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হয়েছে, সে বিষয়ে প্রশ্ন তোলেন আদালত। তখন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ আওলাদ হোসেন আদালতের কাছে সময় চাইলে আদালত শুনানি মুলতবি করেন। 

শুনানিতে খাত ভিত্তিক হজ প্যাকেজের খরচ তুলে ধরে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে ডলার ও রিয়েলের দাম বেড়েছে। যে কারণে স্বাভাবিকভাবেই বিভিন্ন খাতের খরচ বেড়েছে। আর হজ যাত্রায় এয়ার লাইনস নির্ধারণ করেছে সৌদি আরব। তাছাড়া হজ প্যাকেজের মূল্য নির্ধারণ সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সিদ্ধান্ত। ফলে আদালত নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে না, হস্তক্ষেপ করতে পারে না।  

তখন আদালত বলেন, জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় হলে আদালত প্রশ্ন তুলতে পারে। এদেশর বেশিরভাগ মানুষ মধ্যবিত্ত। মুসলিম মধ্যবিত্তদের ইচ্ছা থাকে হজ করার। কিন্তু অনেকেরই সে সামর্থ্যে থাকে না। যে হজ প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে, তা বেশিরভাগ মধ্যবিত্তের সামর্থ্যের বাইরে। তাই রিটের শুনানি মুলতবি করছি। সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে দেখেন হজ প্যাকেজের মূল্য সহনীয় পর্যায়ে আনা যায় কিনা। মধ্যবিত্তের ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা, সামর্থ্যের কথা বিবেচনা করে যতটুকু সম্ভব হজ প্যাকেজ সহনীয় পর্যায়ে আনার বিষয়টি সরকারের চিন্তা করা উচিত।  

গত ৯ জানুয়ারি সৌদি সরকার ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক হজ চুক্তি সই হয়। চুক্তি অনুযায়ী এ বছর ১ লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জন হজ পালনের সুযোগ পাবেন। এর মধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ১৫ হাজার জন এবং বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ১ লাখ ১২ হাজার ১৯৮ জন হজ পালন করতে পারবেন।

চুক্তির পর গত ১ ফেব্রুয়ারি সরকারি ব্যবস্থাপনায় হজে যাওয়ার প্যাকেজ ঘোষণা করে ধর্ম মন্ত্রণালয়। বিভিন্ন খাত উল্লেখ করা এবার হজ প্যাকেজের মূল্য ধরা হয়েছে ৬ লাখ ৮৩ হাজার ১৮ টাকা। 

চলতি বছর বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরবে যাওয়া ও আসার বিমানভাড়া বেড়েছে ৪০ শতাংশের বেশি। গত বছর যাওয়া-আসার (রাউন্ড ট্রিপ) বিমানভাড়া ছিল ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা। এবার তা ৫৭ হাজার ৭৯৭ টাকা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ১ লাখ ৯৭ হাজার ৭৯৭ টাকা।

রিটে বলা হয়েছে, প্যাকেজে বিমান ভাড়া ধরা হয়েছে ১ লক্ষ ৯৭ হাজার ৭৯৭ টাকা। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরব রুটে বিদ্যমান বিমান ভাড়া ৭৬ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ১ লক্ষ ১০ হাজার টাকা। তাছাড়া প্রতি বছর বাংলোদেশ ও সৌদি আরবের সরকার বিমান বাংলাদেশ ও সৌদি এয়ারলাইনসের টিকেট কিনতে হজ যাত্রীদের বাধ্য করে থাকে। এবারও তাই করা হচ্ছে। অবৈধ সুবিধার জন্যই এই বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে এবং এর মাধ্যমে একজন হজ যাত্রীর ব্যক্তিগত স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ণ করা হচ্ছে।

২০১০ সালে সরকারি হজ প্যাকেজে বিমানভাড়া ছিল ৯৬ হাজার ৪২৫ টাকা। সেই হিসাবে দেড় দশকের কম সময়ে হজ প্যাকেজে বিমানভাড়া দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে।

বিমানভাড়ার পাশাপাশি মক্কা ও মদিনায় হজযাত্রীদের জন্য বাড়িভাড়া বাবদ ব্যয়ও বেড়েছে। গত বছর হজ প্যাকেজে বাড়িভাড়া (ভ্যাটসহ) ছিল ৬ হাজার ৫০৪ রিয়েল বা ১ লাখ ৫৮ হাজার ৫৭ টাকা। এ বছর তা বেড়ে হয়েছে ৭ হাজার ২০১ রিয়েল বা ২ লাখ ৪ হাজার ৪৪৫ টাকা। গত বছর বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রতি রিয়েলের দাম ২৪ দশমিক ৩ টাকা হিসাব করা হয়েছিল। চলতি বছর তা হিসাব করা হয়েছে ২৮ দশমিক ৩৯ টাকা ধরে।

বাড়িভাড়া নিয়ে রিটে বলা হয়েছে, সরকারি হজ প্যাকেজে হজ যাত্রীদের জন্য মক্কা-মদিনায় যে বাড়ি ভাড়া ধরা হয়েছে তা অনেক বেশি। এতে বোঝা যায় যে, সরকার বাড়ির মালিকদের স্বার্থে অতিরিক্ত ভাড়া নির্ধারণ করেছে।

বাড়ি ভাড়ার পাশাপাশি মক্কা-মদিনায় হজ যাত্রীদের পরিবহন, জমজম পানি, বিভিন্ন সার্ভিস চার্জ বাবদ যে খরচ বা মূল্য ধরা হয়েছে, সেসব খরচ কমিয়ে হজ প্যাকেজ চার লাখে নামিয়ে আনার দাবি রিটকারী আইনজীবীর।

সূত্রঃ কালের কন্ঠ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *