২০২০ সালের ১১ মার্চ, এই দিনটিতে গোটাবিশ্বে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় মহামারি ঘোষণা করেছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। তিন বছর ধরে করোনা আক্রান্ত হয়ে লাখ লাখ মানুষের প্রাণ গেছে। বিশ্ব অর্থনীতিকে কার্যত নিষ্ক্রিয় করে ফেলেছিল এই মহামারি। কিন্তু আজও কোথা থেকে এই ভাইরাস ছড়িয়েছে সেই ধোঁয়াশা কাটেনি। ফলে করোনার উৎস সম্পর্কে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
করোনাভাইরাস ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের শেষের দিকে চীনের উহানে সনাক্ত হয়। এটি ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সামুদ্রিক খাবারের পাইকারি বাজারের সঙ্গে সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি মার্কেটটি বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং সেটি পরিষ্কার করা হয়। সেই বাজারে আনা প্রাণী থেকেই ছড়িয়েছে করোনা যেটি পরবর্তীতে মানবদেহে ছড়ায়, এমন ধারণা বিশেষজ্ঞদের।
করোনার উৎসের তদন্তের শুরু থেকেই সমালোচনামূলক তথ্যের ঘাটতি রয়েছে এবং চীন, ডব্লিউএইচওসহ অন্যান্য গবেষকদের অবশিষ্ট ডেটা দিতে অস্বীকার করেছে।
এই তদন্তের ফলাফলের জায়গায় রয়েছে প্রতিযোগিতামূলক আখ্যান। একদল গবেষক করোনার প্রাকৃতিকভাবে প্রাদুর্ভাবকে সমর্থন করেন। আরেক দল গবেষক ধারণা করেন এটি দুর্ঘটনাক্রমে উহান ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজি থেকে ছড়িয়েছে যা সেই বাজার থেকে এক কিলোমিটারেরও কম দূরে অবস্থিত। একই ধরনের দুর্ঘটনা আগে তাইওয়ান, চীন এবং সিঙ্গাপুরে ঘটেছে। চ্যাপেল হিলের নর্থ ক্যারোলিনা ইউনিভার্সিটিসহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ল্যাবগুলোতেও ভুল হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
আবার ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিকসহ কেউ কেউ ধারণা করেন কোভিড-১৯ একটি জৈব অস্ত্র হতে পারে। যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা চীন তাদের রাজনৈতিক ঝুঁকির ওপর ভিত্তি করে ছড়িয়েছে।
অনেকে বলছেন, আমরা আসলে তাহলে কী জানি এবং বিজ্ঞান কী পরামর্শ দেয় এর উৎস সম্পর্কে সেটি জানা জরুরি। সংক্ষেপে বললে বিজ্ঞানী ও অন্যান্য বিশেষজ্ঞরা একটি প্রাকৃতিক কারণ ধারণা করার দিকে ঝুঁকছেন। সেটি হচ্ছে ভাইরাসটি প্রকৃতপক্ষে প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু চীনের অস্বচ্ছতা এবং সে সময়কাল থেকে প্রমাণের অভাবে বিজ্ঞানীদেরকে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে বাধা দিয়েছে। শুধু তাই নয় ষড়যন্ত্র তত্ত্বকে আরও পাকাপোক্ত করেছে বিষয়টি।
ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে মার্কিন একটি গোয়েন্দা সংস্থা ‘নমনীয়ভাবে’ জানায় তারা ধারণা করে অপ্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে ভাইরাসটি ল্যাব থেকে লিক হয়ে ছড়িয়েছে। কিছু সময় পর এফবিআই পরিচালক ক্রিস্টোফার ওয়েও বলেন ব্যুরো ‘এখন বেশ কিছু সময়ের জন্য, মূল্যায়ন করে যে মহামারির উৎস উহানের একটি ল্যাব।’ যদিও অন্যান্য চারটি মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা ও ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স কাউন্সিল পূর্বে ‘কম নিশ্চিয়তা’ দিয়ে উপসংহারে পৌঁছায় যে ভাইরাসটি প্রাকৃতিকভাবে ছড়িয়েছিল।
কিন্তু যখন ল্যাব ফাঁস তত্ত্ব অত্যন্ত রাজনৈতিক হয়ে উঠেছে, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনার কারণে। তখন কোভিড -১৯ এর উৎস সম্পর্কে বেইজিংয়ের স্বচ্ছতার অভাব উদ্বেগ বাড়াচ্ছে।
সেই বাজারের মূল্যবান প্রমাণ অপসারণ করার পাশাপাশি, চীন ২০২০ সালের ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণের মাধ্যমে ভাইরাসটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে সংক্রামক ঘোষণা করেনি। যদিও ডিসেম্বরের শেষের দিকে অজানা ভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উন্নত পর্যবেক্ষণ কৌশল ব্যবহার করা শুরু হয় দেশটিতে।
ওরেগন স্টেট ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর গ্লোবাল হেলথের ডিরেক্টর চুনহুই চি আল জাজিরাকে বলেন, ‘আমি একশভাগ নিশ্চিত চীন এই সত্যটি লুকিয়ে রেখেছিল। তারা জানতো এটি সংক্রামক। তারা ডিসেম্বরের শুরুতে নমুনা সংগ্রহ করা শুরু করে যার মানে তারা এই রোগ সম্পর্কে অনেক আগেই জানতো।’
তিনি বলেন, ‘যদি তারা আগে সংক্রামক প্রকৃতি সম্পর্কে তথ্য প্রকাশ করতো তাহলে আমরা মহামারির কবলে পড়তাম না।’
অন্যান্য কারণও চীনের কার্যক্রম সম্পর্কে সন্দেহ তৈরি করে। চীন লি ওয়েনলিয়াংকেও শাস্তি দিয়েছে যিনি প্রথম নতুন ভাইরাস সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন।
২০২১ সালের মে মাসে অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন জীববিজ্ঞানী মাইকেল ওরোবে এবং সিয়াটেলের ফ্রেড হাচিনসন ক্যান্সার সেন্টারের ভাইরোলজিস্ট ও অধ্যাপক জেসি ব্লুমসহ বিশিষ্ট বিজ্ঞানীদের একটি দল করোনার উৎস সম্পর্কে আরও গবেষণার আহ্বান জানান।
তত্যসূত্র: আল-জাজিরা, জাগোনিউজ