নিজস্ব প্রতিবেদক:
মাল্টিলেভেল মার্কেটিং কোম্পানি মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জ (এমটিএফই) গ্রুপ রাজশাহীর শত শত মানুষকে তাদের প্রতারণার ফাঁদে ফেলেছিল। এমটিএফইয়ের কর্মীরা গত জুলাই পর্যন্ত অন্তত চারমাস প্রকাশ্যে কার্যক্রম চালিয়েছে। এর মধ্যে রাজশাহী থেকে কয়েকশ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে অ্যাপটি।
গত ২৩ জুলাই এমটিএফইয়ের বিরুদ্ধে ‘‘বহির্ভূত ই-ট্রানজেকশনের মাধ্যমে প্রতারণার’ অভিযোগে আদালতে মামলা দায়ের করা হয়। এরপর দুবাইভিত্তিক এই প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা আত্মগোপন করেন।
মামলা দায়েরের দিনই রাজশাহীর সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. জিয়াউর রহমান ঘটনাটি ‘গুরুত্বপূর্ণ’ উল্লেখ করে রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ (আরএমপি), পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) যৌথ দল গঠন করে তদন্ত করতে নির্দেশ দেন। তারপরও এমটিএফইয়ের কর্মীরা পাড়া-মহল্লায়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘রাতারাতি কোটিপতি হওয়ার স্বপ্ন দেখিয়ে’ শত শত মানুষকে এমটিএফই স্মার্টফোন অ্যাপ্লিকেশন ও ওয়েবসাইটে লাখ লাখ টাকা বিনিয়েগে উদ্বুদ্ধ করার কাজটি অব্যাহত রেখেছিল।
গত ১৭ আগস্ট এমটিএফই শত শত মানুষের বিনিয়োগ কেড়ে নিয়ে স্মার্টফোন অ্যাপলিকেশন ও ওয়েবসাইট বন্ধ করে দেয়। এমটিএফই বন্ধ হওয়ার সপ্তাহ পরে এবং আদালতের আদেশের প্রায় একমাস পরে বৃহস্পতিবার (২৪ আগস্ট) রাজশাহী থেকে দেবেন্দ্রনাথ সাহা (৪৩) ও নওগাঁর লতিফুল বারী (৪২) নামে দুইজনকে গ্রেফতার করে।
রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার বিপ্লব বিজয় তালুকদার বলেন, ‘আদালতের নির্দেশে আমরা যৌথ তদন্ত দল গঠন করেছি। মামলাটির তদন্ত চলছে। বেশ কয়েকজনকে শনাক্ত করা হয়েছে। কিন্তু তারা আত্মগোপনে আছে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নগরীর আহমেদপুর এলাকায় এমটিএফই প্রতারণার শিকার কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা এমটিএফইতে বিনিয়োগ শুরু করেছিলেন গত এপ্রিল মাসে থেকে। স্মার্টফোন অ্যাপ্লিকেশনটি আগস্ট মাসে তাদের বিনিয়োগ কেড়ে বন্ধ হওয়ার আগ পযর্ন্ত তাদের মধ্যে কেউ কেউ কিছু মুনাফা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল।
প্রতারণার শিকার ভুক্তভোগীরা জানায়, এমটিএফইয়ের স্থানীয় কর্মীদের নগদ টাকা সরবরাহ করা হতো। এর বিনিময়ে তাদের এমটিএফই অ্যাপে হিসাব খুলে দেওয়া দিতো তারা। অ্যাপে ৫০০, ৯০০ ও ১ হাজার ৫০০ ইত্যাদি নানান অংকের মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করার সুযোগ ছিল। তাদের বেশির ভাগই ৫০০ থেকে ৯০০ ডলার বিনিয়োগ করেছিলেন। কেউ কেউ আরও বেশি।
বিনিয়োগের পর সপ্তাহে ৩ থেকে ৫ দিন বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ উত্তোলনের সুযোগ দেওয়া হতো। এই দিনগুলোতে তাদের হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানো একটি নির্দিষ্ট সময় থেকে ৩০ মিনিট ধরে তাদেরকে অ্যাপে বিনিয়োগ ও লভ্যাংশ উত্তোলনের সুযোগ দেওয়া হতো। তারা ৫০০ ডলার বিনিয়োগ করে নির্দিষ্ট দিনে ২২ ডলার উত্তোলন করতে পারতেন। অনেক সময় পারতেন না। তবে মূল বিনিয়োগের টাকা কেউ ফেরত পায়নি।
রাজশাহী জজ কোর্টের আইনজীবী জহুরুল ইসলাম গত ২৩ জুলাই জনস্বার্থে রাজশাহীর সাইবার ট্রাইব্যুনালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা দায়ের করেন। তিনি বলেন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যথাযথ ব্যবস্থা না নেওয়ায় একের পর এক বিদেশি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়াই সাধারণ মানুষকে বিনিয়োগের ফাঁদে ফেলছে।
মামলার বিবরণে বলা হয়, এমটিএফই নগরীর লক্ষ্মীপুর এলাকায় একটি কার্যালয় করা হয়েছিল। সবুজ নামে এক যুবক এটি পরিচালনা করছিলেন। দুর্গাপুরের রুবেল নামে আরও এক যুবকের নাম উল্লেখ আছে, যিনি শত শত মানুষকে এমটিএফইতে বিনিয়োগের প্রলোভন দেখিয়ে ছিলেন। বিনিয়োগ থেকে তিনি কমিশন পেতেন। এর আগেও এমটিএফই ছাড়া আরও কয়েকটি অ্যাপে বিনিয়োগ করে হাজার হাজার মানুষ প্রতারিত হয়েছেন বলে মামলায় উল্লেখ করা আছে।
মামলার বিবরণে আরও বলা হয়, নগরীর দাসমারী এলাকার সবুজ, লিটন ও একলাস আল্টিমা ওয়ালেট অ্যাপে প্রায় ২০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন। এ ঘটনায় গত ২৬ জুন সবুজ আলী বাদী হয়ে বোয়ালিয়া থানায় মামলা করলে পুলিশ ছয়জনকে গ্রেফতার করে।
আইনজীবী জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘কেউ যদি ১০০টি বিনিয়োগ জোগাড় করতে সক্ষম হয়, তবে সে একটি অফিস খোলার যোগ্যতা অর্জন করে এবং সিইও পদ লাভ করে। এভাবে রাতারাতি কোটিপতি হওয়ার স্বপ্নে টাকা বিনিয়োগ করে শত শত মানুষ এমটিএফইর ফাঁদে পড়ছেন।’
জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘এ ধরনের অ্যাপগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার দিন পর্যন্ত মানুষকে বিনিয়োগের সুযোগ করে দেয়। পরে সুযোগ বুঝে বিনিয়োগকৃত টাকা উত্তোলন করে অ্যাপ বন্ধ করে দেয়। তারও আগে মহানগর এলাকা ও গোদাগাড়ী এলাকার অনেক মানুষ অন্য আরেকটি অ্যাপের মাধ্যমে প্রতারিত হয়েছেন।’
আদালতের আদেশ
আদেশে রাজশাহীর সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক জিয়াউর রহমান ঘটনাটি তদন্তের গুরুত্বের কথা অন্তুত দুইবার উল্লেখ করেছেন। আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর ইসমত আরা বলেন, ‘আদালত রাজপাড়া থানার ওসিকে অবিলম্বে অভিযোগটি প্রাথমিক তথ্য বিবরণীর নথিভুক্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন। অপরাধের গুরুত্ব বিবেচনা করে এবং সুষ্ঠু তদন্তের জন্য আদালত আরএমপির রাজপাড়া থানা, সিআইডি ও পিবিআইয়ের সমন্বয়ে একটি যৌথ তদন্ত দল গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন।’
আদেশে বিচারক বলেন, আদালত এর আগেও একই ধরনের কয়েকটি মামলা নিষ্পত্তি করেছে এবং বর্তমানে একই পদ্ধতিতে আরও এক প্রতারক চক্র মাঠে নেমেছে। আদেশ উল্লেখ করা হয়, একই দিনে থানায় মামলা নথিভুক্ত করা হয়েছিল, তবে একমাস পর এমটিএফই বন্ধ হওয়ার আগে পুলিশের এই যৌথ দলের কোনো ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়নি।