নিজস্ব প্রতিবেদক:
পঙ্গু ও আশ্রমের বৃদ্ধাদের নিয়ে বিভিন্ন সঙ্কটে ধুঁকছে পুঠিয়ার পঙ্গু শিশু নিকেতন। নিকেতনে পঙ্গু শিক্ষার্থী, অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের থাকার ব্যবস্থা থাকলেও খাবার, শিক্ষা ও চিকিৎসার খরচ জোগাতে হিমসিম খেতে হচ্ছে কর্তৃপক্ষকে। তার উপরে কর্তৃপক্ষের দাবি- প্রতিষ্ঠানগুলোতে মেলেনা সরকারিভাবে সহযোগিতা। তবে ১০ বছর আগেও ৭০-৮০ জন পঙ্গুর শিক্ষা নিশ্চিত করা গেলেও বর্তমানে কমেছে শিক্ষার্থী।
রাজশাহী জেলার পুঠিয়া উপজেলার উত্তর-পূর্ব দিকের ৫ নম্বর শিলমারী ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সাধনপুরে এই পঙ্গু নিকেতনটি। পদ্মার শাখা বড়াল নদীর ধারে এই সাধনপুরে ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে তোলা হয়েছে পঙ্গুদের জন্য পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এগুলোর মধ্যে রয়েছে, পঙ্গু শিশু নিকেতন প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ডিগ্রি কলেজ, বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কলেজ, অন্ধ শিক্ষা কার্যক্রম, পঙ্গু শিশুদের আবাসস্থল, বৃদ্ধাশ্রম ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।
সরেজমিনে দেখা গেছে, বর্তমানে পঙ্গু শিশু নিকেতনে ২০ জন পঙ্গু শিক্ষার্থী রয়েছে। তারা বিনা খরচে আবাসন, খাবার ও চিকিৎসা সেবা পাচ্ছে। একই সাথে তারা লেখাপড়ার সুযোগ পাচ্ছে। অপরদিকে, পরিবারের সদস্যদের অত্যাচার, নির্যাতন অথবা আশ্রয়হীন এমন ১০জন বয়স্ক নারী-পুরুষ থাকেন প্রতিষ্ঠানটির পরিচালিত বৃদ্ধাশ্রমে। তবে কর্তৃপক্ষের আর্থিক সঙ্কটের কারণে কোনোমতে পঙ্গু শিক্ষার্থী ও বৃদ্ধাশ্রমের মানুষগুলোর থাকা, খাওয়া ও প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হচ্ছে।
তবে প্রতিষ্ঠার পর বৈদেশিক ও সরকারি সহায়তা পেলেও ২০১৪ সাল থেকে তা পুরোপুরি বন্ধ। ট্রাস্টের আবাদি জমি, পুকুর ও আমবাগানের ইজারার আয়ে কোনোভাবে চলে কার্যক্রম। প্রতিবছর ব্যয় হয় অন্তত ১৩ লাখ টাকা। তবে উৎস থেকে আসা আয়ে ব্যয়ের টাকায় ঘাটতি থাকে। ফলে আয় না থাকলেও ব্যয়ের টাকা জোগাতে হিমসিম খেতে হয় কর্তৃপক্ষকে।
জানা গেছে, বাংলা একাডেমির কর্মকর্তা আবদুল মজিদের ঘর আলো করে ১৯৭২ সালে জন্ম নেয় কন্যা বেবী বালী। ৩ বছরের মাথায় হঠাৎ করেই ফুটফুটে সুস্থ সবল শিশুটি হয়ে পড়ে অসুস্থ। হারিয়ে যায় উত্থান, বাক ও স্মৃতিশক্তি। দেশ-বিদেশে চিকিৎসা করেও বাঁচানো যায়নি তাকে। কন্যাকে হারিয়ে পাগলপ্রায় অবস্থা হয় আব্দুল মজিদের। তবে শোককে রূপান্তর করেন শক্তিতে। কন্যা বেবী বালীর স্মরণে প্রতিবন্ধী শিশুদের যাপিত জীবনের প্রতিবন্ধকতা দূর করতে বাবা-মায়ের ২৫ বিঘা জমিতে প্রতিবন্ধী শিশুদের থাকার জন্য নির্মাণ করেন টিনের ঘর। এই টিনের ঘরে তার প্রচেষ্টায় সাধনপুরে ১৯৭৮ সালে যাত্রা শুরু হয় পঙ্গু শিশু নিকেতনের।
প্রতিষ্ঠাতা আব্দুল মজিদ ২৫ বিঘার পঙ্গু শিশু নিকেতনকে ৬০ বিঘায় উন্নীত করেন। এতে গড়ে তোলা হয়েছে, পঙ্গু শিশু নিকেতন প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ডিগ্রি কলেজ, বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কলেজ, অন্ধ শিক্ষা কার্যক্রম, পঙ্গু শিশুদের আবাসস্থল, বৃদ্ধাশ্রম ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।
শুধু তাই নয়, এটি বাংলাদেশের এক মাত্র পঙ্গু বিএম কলেজ। এখানে বিভিন্ন পঙ্গুু ছেলেমেয়েরা শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ পাচ্ছে। এখানে পঙ্গু শিশুদের জন্য ফিজিও থেরাপি ও ইলেকট্রো থেরাপির ব্যবস্থা রয়েছে। এই চিকিৎসার জন্য রয়েছেন চিকিৎসক।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১৫ সালের প্রথম দিকে সমাজসেবা অধিদফতর থেকে পঙ্গু শিশু নিকেতন সমন্বিত বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কলেজ বিএম শাখায় দেয়া হয়েছে চেয়ার টেবিল। এখানে আয়ের উৎস বলতে, সাতটি পুকুর ও একটি ধান ভাঙানো মিল। আর বাকিগুলো আবাদি জমি হিসেবে রয়েছে। এ থেকে বছরে যা আয় হয় তা দিয়ে চলে এখানকার পঙ্গু শিশুদের লেখাপড়া ও চিকিৎসাসেবা।
সিরাজগঞ্জ থেকে আসা দৃষ্টি প্রতিবন্ধী সবুজ শেখ থাকেন এই পঙ্গু নিকেতনে। তিনি বলেন, একাদশ শ্রেণিতে পড়াশোনা করেন তিনি। এই প্রতিষ্ঠানে তার আসা প্রায় এক বছর। কর্তৃপক্ষ অনেক ভালো কাজ করেন। তারা আমাদের মতো প্রতিবদ্ধীদের থাকার ব্যবস্থা করেছে। একই সাথে শিক্ষা, খাওয়া-দাওয়া ও থাকার ব্যবস্থা করেছে। এখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না থাকলে আমাদের লেখাপড়ার বিঘ্ন ঘটতো। পড়াশোনার জন্য অনেক দূরে যেতে হতো। এতে করে শিক্ষাজীবন অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পাবতো।
পঙ্গু নিকেতনে থাকা অপর শিক্ষার্থী বলেন, মাটির দেওয়াল পড়ে পা ভেঙ্গে গেছে তার। তার বাড়ি থেকে স্কুল-কলেজ অনেক দূরে। দূর হওয়ায় সেখানে লেখাপড়া করতে তার কষ্ট হয়। এখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুব কাছে কাছে। এছাড়া এখানে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। এখানে অসুস্থ হলে চিকিৎসা পাওয়া যায়।
পঙ্গু শিশু নিকেতনের সভাপতি মো. মুরছালাত বলেন, ১৯৪৬ সালে জন্ম নেয়া আব্দুল মজিদ ২০১৯ সালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। জীবিত থাকতে সাদা মনের মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া মজিদের সারাজীবনের ব্রত ছিল মানবপ্রেম। এলাকায় শিশু পার্ক, সড়ক নির্মাণের পাশাপাশি তিনি রোপন করেছেন হাজারো গাছ।
তিনি আরো বলেন, এই প্রতিষ্ঠানে সরকারিভাবে সহযোগিতা পাওয়া যায় না। এখানে আমাদের আয়ের কিছু উৎস আছে যেমন পুকুর, ধানি জমি ও বিভিন্ন ফলের গাছ ইত্যাদি। সেই টাকায় কোনো মতে চলে প্রতিষ্ঠানগুলো। তারপরেও কমতি হলে বিভিন্ন দানশীল ব্যক্তি সাহায্য করে থাকেন। এছাড়া স্থানীয় চেয়ারম্যানের মাধ্যমে সহযোগিতা পাওয়া যায়।
পুঠিয়ার ৫ নম্বর শিলমাড়িয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সাজ্জাদ হোসেন মুকুল বলেন, প্রতিষ্ঠানটি সরকারি কোনো সুযোগ সুবিধা পায় না। ব্যক্তি উদ্যাগে কমিটির মাধ্যমে পরিচালিত হয়। তবে সমাজসেবার রেজিস্ট্রেশন আছে। পঙ্গুদের শিক্ষা, থাকা, খাওয়ার ব্যবস্থা করা এটি অনেক ভালো উদ্যোগ। পঙ্গু নিকেতনে সরকারি বা বেরসরকারি এনজিওগুলোর সহযোগিতা পেলে ভালোভাবে চলতো।
পুঠিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা একেএম নূর হোসেন নির্ঝর বলেন, রাজশাহী জেলা প্রশাসক একটি বরাদ্দ দিয়েছেন। দ্রুত পঙ্গু শিশু নিকেতনে ওয়াস রুমের কাজ শুরু হবে। আমাদের সাধ্য মতো সহযোগিতার চেষ্টা করি।