নিউজ ডেস্ক:
নজিরবিহীন ধর্মঘট চলছে যুক্তরাষ্ট্রের চলচ্চিত্র জগতের প্রাণকেন্দ্র হলিউডে। গত ছয় দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় এই ধর্মঘটে চিত্রনাট্যকারদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন অভিনয়শিল্পীরাও। দেড় লাখের বেশি অভিনেতা, কুশলী কাজ বন্ধ করে দেওয়ায় অবতার এবং গ্ল্যাডিয়েটর সিরিজের সিনেমাগুলোর নির্মাণকাজ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ধর্মঘটের সময় অভিনেতারা চলচ্চিত্রে উপস্থিত হবেন না বা প্রচারও করবেন না।
কেন এই ধর্মঘট : মুনাফা থেকে ন্যায্য পাওনা, ভালো কর্মপরিবেশের দাবিতেই এই ধর্মঘট শুরু করেছে অভিনয়শিল্পীদের সংগঠন দ্যা স্ক্রিন অ্যাক্টর গিল্ড বা এসএজি। এসএজির এই ধর্মঘট লস এঞ্জেলস সময়ে গত বৃহস্পতিবার রাতে শুরু হয়। পরদিন ক্যালিফোর্নিয়ায় নেটফ্লিক্স সদরদপ্তর ছাড়াও প্যারামাউন্ট, ওয়ার্নার ব্রস ও ডিজনির সামনে শিল্পী-কুশলীরা জড়ো হয়। শিল্পীদের ইউনিয়ন বলেছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং কম্পিউটার জেনারেটেড চেহারা বা কণ্ঠ যেন শিল্পীদের জায়গায় ব্যবহার না করা হয়। ধর্মঘটের বিষয়ে ইউনিয়ন যে ঘোষণা দিয়েছে তাতে দেখা যায়, অভিনয়শিল্পী ছাড়াও গান, নৃত্য, স্ট্যান্ট পারফরমার এবং পাপেট বা মোশন পিকচার নিয়ে যারা কাজ করেন তারাও এর আওতায় আছেন।
মূলত স্টুডিওগুলোর সঙ্গে আলোচনা ফলপ্রসূ না হওয়ায় বুধবার দ্যা স্ক্রিন অ্যাক্টর গিল্ড-আমেরিকান ফেডারেশন অব টেলিভিশন অ্যান্ড রেডিও আর্টিস্ট বা এসএজি-আফট্রা জানিয়ে দেয় যে, তারা স্টুডিওগুলোর সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছাতে পারেনি। এরপর আলোচনার জন্য তাদের কমিটি সর্বসম্মতভাবেই ধর্মঘটের প্রস্তাব করে। তবে স্টুডিওগুলোর প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন—দ্যা অ্যালায়েন্স অব মোশন পিকচার অ্যান্ড টেলিভিশন প্রডিউসারস বা এএমপিটিপি এ সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করেছে। তারা বিবৃতি দিয়ে বলেছে, ইউনিয়নের সিদ্ধান্ত ইন্ডাস্ট্রির ওপর আর্থিকভাবে নির্ভরশীল হাজার হাজার মানুষকে সংকটের দিকে নিয়ে যাবে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার নিয়ে উদ্বেগের বিষয়ে এএমপিটিপি বলেছে, তারা এ নিয়ে একটি ‘যুগান্তকারী প্রস্তাবে’ একমত হয়েছে—যা অভিনয়শিল্পীদের ডিজিটাল প্রতিলিপি ব্যবহারের ক্ষেত্রে সুরক্ষা দেবে এবং কোনো শিল্পীর ডিজিটাল রেপ্লিকা ব্যবহার করা হলে তার সম্মতি নিতে হবে। তবে এসএজির পক্ষে থাকা প্রধান আলোচক ডানকান ক্রাবট্রি-আয়ারল্যান্ড বলেছেন, এ প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য নয়।
অনলাইন স্ট্রিমিং সার্ভিসগুলোর বিষয়ে এসএজির দাবি ছিল—চলচ্চিত্র বা অনুষ্ঠান পুনঃপ্রচার হলে সেজন্য শিল্পীদের অর্থ দিতে হবে। ওদিকে রাইটার্স গিল্ড অব আমেরিকা আরেকটি ধর্মঘট চালিয়ে যাচ্ছে। এ সংগঠনের প্রায় সাড়ে এগারো হাজার সদস্য আছে। তারা পারিশ্রমিক বৃদ্ধি ও ভালো কর্মপরিবেশের দাবিতে গত ২ মে থেকেই এই ধর্মঘটে আছে।
কাজ স্থবির হওয়ার আশঙ্কা : এই ধর্মঘটের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের চলচ্চিত্র ও টিভি প্রডাকশনের বড় অংশের কাজ স্থবির হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। বিদেশি গণমাধ্যমগুলোর খবরে বলা হচ্ছে—ধর্মঘটে আটকে যাচ্ছে অবতার, ডেডপুল, গ্ল্যাডিয়েটরের সিক্যুয়েল সিনেমাসহ স্ট্রেঞ্জার থিংস, ফ্যামিলি গাই, দ্য সিম্পসনের মতো টিভি সিরিজ। ধর্মঘটের প্রভাব কেবল যুক্তরাষ্ট্রেই সীমাবদ্ধ থাকবে, এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। যুক্তরাষ্ট্রের বাইরের যে দেশগুলোয় যুক্তরাষ্ট্রের নির্মাতারা আছেন, যারা ইংরেজি ভাষায় সিনেমা এবং টেলিভিশন শো করে থাকেন, তারাও বিপাকে পড়বেন। অর্থাত্ যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডসহ যেখানে যেখানে হলিউডি সিনেমার স্টুডিও আছে, সেখানেও এই ধর্মঘটের আঁচ লাগবে। ফলে বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বৃহস্পতিবার ইউনিয়নগুলো ধর্মঘটের ডাক দেওয়ার পর ডিজনির সিইও বব আইজার বলেন, শিল্পী ও লেখকদের দাবিগুলো অবাস্তব এবং করোনা মহামারিতে হওয়া ক্ষতি থেকে উত্তরণের চেষ্টায় থাকা ইন্ডাস্ট্রির জন্য এটি ক্ষতিকর। ধর্মঘট দীর্ঘায়িত হলে দর্শকদের জন্য টেলিভিশনের নামমাত্র কিছু অনুষ্ঠান এবং বিভিন্ন ধরনের খেলা সরাসরি দেখা ছাড়া আর কিছুই থাকবে না।
সমাধান কোন পথে : ধর্মঘট নিরসনের উপায় খুঁজতে ভবিষ্যতে অভিনয়শিল্পীদের সমিতি এসএজির সঙ্গে অভিনয়শিল্পীদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন ও হলিউড স্টুডিওগুলোর মধ্যে বৈঠক হবে। ঐ ধর্মঘট থেকে সংকটের সমাধান খোঁজার চেষ্টা হবে সব পক্ষ থেকে।
লেখক এবং শিল্পীদের একযোগে দুটি ধর্মঘট ১৯৬০ সালের পর এই প্রথম। তখন এসএজির নেতৃত্বে ছিলেন অভিনেতা রোনাল্ড রিগ্যান, যিনি পরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। সে সময় লেখকরা কাজ বন্ধ রেখেছিলেন ২১ সপ্তাহ আর অভিনেতারা ছয় সপ্তাহ তাদের কাজ থেকে বিরতি নিয়েছিলেন। আর অভিনয়শিল্পীরা সর্বশেষ ধর্মঘট করেছিলেন ১৯৮০ সালে। সেবার ১০ সপ্তাহের বেশি স্থায়ী হয় ঐ কর্মবিরতি। ঐ ধর্মঘটে ৩৭ কোটি ডলারের বেশি আর্থিক ক্ষতি হয়েছিল। তবে এবারের সমস্যা দীর্ঘায়িত হতে পারে। কারণ প্রভাবশালী অভিনেতারা ‘এসএজি-এএফটিআরএ’কে দাবি আদায়ে কঠোর হতে চাপে রেখেছেন।